মানবতার পাশে দাঁড়ানো এটি কোনো স্লোগান নয়, বরং একটি অঙ্গীকার। বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বেচ্ছাসেবী মানবিক আন্দোলন রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট এই অঙ্গীকারকেই ধারণ করে এগিয়ে চলছে নিরলসভাবে। ২০২৫ সালের বিশ্ব রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট দিবসের প্রতিপাদ্য “On the side of Humanity” বা “মানবতার পাশে, একসাথে”-এটি শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, এটি একটি বাস্তবতা, যা প্রতিনিয়ত প্রমাণ করছে বিশ্বের ১৯১টি দেশে।
বিশ্বব্যাপী যখন মানবতা নানা সংকটে বিপর্যস্ত, তখন এই বছরের প্রতিপাদ্য “On the side of Humanity” আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। এ প্রতিপাদ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়-মানবতা কেবল একটি নীতি নয়, এটি একটি দায়িত্ব এবং এই দায়িত্ব পালনে রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সর্বদা প্রস্তুত ।
রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের শেকড় গেঁথে আছে ১৮৫৯ সালের রক্তক্ষয়ী সলফেরিনোর যুদ্ধে । সুইজারল্যান্ডের নাগরিক জীন হেনরি ডুনান্ট তখন এক ব্যবসায়িক সফরে গিয়ে প্রত্যক্ষ করেন যুদ্ধক্ষেত্রের নির্মমতা। হাজার হাজার আহত সৈনিক না খেয়ে, না পান করে, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। সে দৃশ্য তার হৃদয়কে বিচলিত করে তোলে। তিনি নিজেই স্থানীয় মানুষদের নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন এবং পরে নিজের অভিজ্ঞতার উপর “A Memory of Solferino” নামে একটি বই লেখেন।
এই বই বিশ্বব্যাপী মানবিক চেতনার সাড়া জাগায়। ১৮৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ দ্য রেড ক্রস (ICRC), এবং ১৮৬৪ সালের জেনেভা কনভেনশনের মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্রে আহতদের জন্য মানবিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়ন হয়।
আজ, রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, বরং প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী, শরণার্থী সংকট, স্বাস্থ্য ও খাদ্য সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন, এবং মানসিক স্বাস্থ্যসহ নানাবিধ মানবিক সংকটে কাজ করছে।
১) মানবতা, ২) পক্ষপাতহীনতা, ৩) নিরপেক্ষতা, ৪) স্বাধীনতা, ৫) স্বেচ্ছাসেবা, ৬) একতা এবং ৭) সার্বজনীনতা, এই সাতটি মৌলিক নীতির ভিত্তিতে রেড ক্রস রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলন পরিচালিত হয়। এটি কেবল দাপ্তরিক নীতি নয়-এটি একটি জীবন্ত চেতনা, যা প্রতিটি স্বেচ্ছাসেবকের প্রতিটি কার্যক্রমে প্রতিফলিত হয়।
যুবরাই এই সংগঠনের প্রাণ। যুব রেড ক্রিসেন্ট (RCY) কার্যক্রমের মাধ্যমে তরুণরা দেশজুড়ে নানা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এবং দুর্যোগে উদ্ধার ও পুনর্বাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গড়ে ওঠা ইউনিট গুলো তরুণদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ ও নেতৃত্ব বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখে ।
বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তি, সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন, স্বাস্থ্য ঝুঁকি, অভিবাসন সমস্যা এবং গুজব বা ভুল তথ্যের মতো নতুন চ্যালেঞ্জ রেড ক্রিসেন্ট ও রেড ক্রস আন্দোলনের কাজকে আরও জটিল করেছে। কিন্তু চ্যালেঞ্জ যত বড় হোক না কেন, মানবতার পাশে দাঁড়ানোর সংকল্পে কোনো কমতি নেই ।
রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্টের পতাকা কেবল একটি প্রতীক নয়-এটি নিরাপত্তার, বিশ্বাসের, সহমর্মিতার এবং নির্ভরতার প্রতীক। এই পতাকা যেখানে উড়ে, সেখানেই একজন আহত, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ অন্তত আশা করে, কেউ পাশে আছে। কেউ তাদের ব্যথা অনুভব করছে।
২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য “On the side of Humanity” আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়-এই সংগঠন কেবল সেবা নয়, , এটি আশা, এটি সাহস, এটি বিশ্বাস। যেখানে রেড ক্রিসেন্ট পতাকা ওড়ে, সেখানেই একজন অসহায় মানুষ আশার আলো খুঁজে পায় ।
আমরা যারা এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, আমাদের প্রতিটি কাজেই থাকতে হবে দায়বদ্ধতা, সহানুভূতি ও সততা। মানুষ যখন বিপদে পড়ে, তখন সে চায় কেউ পাশে থাকুক। রেড ক্রিসেন্ট সেই পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি।
এই দিনে, আমাদের সবার উচিত নিজ নিজ জায়গা থেকে একটি মানবিক কাজ করা। সেটি হতে পারে একজন অসহায়কে সাহায্য, রক্তদান, অথবা কারো কষ্ট শোনার একটু সময় দেওয়া এই ছোট ছোট কাজগুলোই গড়ে তোলে একটি সহানুভূতিশীল সমাজ।
বিশ্ব রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট দিবসের এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা শপথ করি-বিপদের সময়, দুঃখের সময়, অসহায়ত্বের মুহূর্তে, আমরা মানবতার পাশে থাকব কারণ মানুষের পাশে থাকাই আসল মানবতা ।
মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম
ট্রেজারার, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং
চেয়ারম্যান, সিলেট রেড ক্রিসেন্ট মাতৃমঙ্গল হাসপাতাল ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র।