নূরুল মোহাইমীন মিল্টন, কমলগঞ্জ:
এখন চলছে শুষ্ক মৌসুম। পানি না থাকায় শুকিয়ে যাচ্ছে হাওর, বাওড়, নদী, ছড়া, খাল-বিল ও জলাশয়। ভরাট হচ্ছে মাছের আবাসস্থল। ফলে কমলগঞ্জে প্রবল সংকটে দেশীয় প্রজাতির মা ও বাবা মাছ। পরিবর্তিত জলবায়ুতে ও সুযোগ সন্ধাণী অসাধু মহলের কারণে মৎস্য প্রজননের আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে পড়ছে। নানা কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ হচ্ছে প্রজনন সুবিধা। ফলে কমছে উৎপাদন আর বিলুপ্তির দিকে যাচ্ছে মৎস্য ও জলজ অনেক প্রজাতি। হাটবাজারে দেশীয় প্রজাতির মাছের তীব্র আকাল দেখা দিয়েছে আর দামও বেড়েছে।

স্থানীয়দের মতে, মাছের অভয়ারন্য খ্যাত কমলগঞ্জ উপজেলা তথা মৌলভীবাজার জেলার হাওর, বাওড়, জলাশয়, নদী, খাল-বিলে দেশীয় প্রজাতির মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। পানির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে অনেক জলাশয়। পলি বালুতে অনেক জলাশয়, খাল ভরাট হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়াও চায়ের টিলাভূমি ও আবাদি জমিতে কীটনাশক ব্যবহারে দেশী মাছের প্রজননক্ষেত্র বিনষ্ট হয়ে পড়ছে। নদী ও বিল সেচ, নদীতে বাঁশের বেড়া, কারেন্ট জালের ব্যবহার, হাওর, খাল, পাহাড়ি ঢলে পলি জমে জলাশয় ভরাটসহ নানা কারনে মাছের প্রজনন মাত্রাতিরিক্ত হারে হ্রাস পেয়েছে। হাটবাজারে যেমন দেশীয় মাছের আকাল তেমনি খামারিদের চাষাবাদকৃত বিদেশী প্রজাতির মাছে বাজার দখলে রয়েছে। আমিষের চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ উৎস্য মাছের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় প্রকৃতিতে হারিয়ে যাচ্ছে সমস্থ মা ও বাবা মাছ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শুষ্ক মৌসুমে খাঁ খাঁ করছে মাঠঘাট। সেই সাথে জলাশয়গুলোও শুকিয়ে যাচ্ছে। বর্ষায় অতিবৃষ্টির সময়ে উজানের ঢলে পলিবালিতে বিল, হাওর ও জলাশয়গুলো ভরাট হয়ে পড়ছে। এতে মাছের প্রজননস্থল ধ্বংস হচ্ছে। আবহাওয়ার তারতম্যে বর্ষা মওসুমে চাহিদা মতো বৃষ্টিপাত না হওয়ায় একদিকে আমন চাষাবাদে ব্যাঘাত ঘটে। অন্যদিকে মৎস্যজীবিরাও দুর্বিষহ জীবন ধারণ করছেন। তাছাড়া মৎস্য আইন সম্পর্কে ব্যাপক জনসাধারণের সচেতনতার অভাবে বিভিন্ন সময়ে অপরিকল্পিতভাবে ডিমওয়ালা ও পোনা মাছ নিধন, কারেন্ট জাল ব্যবহার, নদী ও বিল সেচ, নদীতে আড়াআড়িভাবে বাঁশের খাঁটি ও বাঁধ নির্মাণ করে মাছের বংশবিস্তার ধ্বংস করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে ঘোড়া মাছ, নান্দিনা, স্বরপুটি, মহাশোল, রিটা, ঘাউরা, বাচা, শিলং, পাঙ্গাস, বাঘাইর, চেনুয়া, ভাঙ্গন, পিলা শোল, চিতল, কালি বাউশসহ ৬৪ প্রজাতির দেশীয় মাছ বিলুপ্তির পথে। অথচ দেশীয় মাছ আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং প্রাণিজ আমিষের প্রধান উৎস। বর্তমান পরিস্থিতি প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ উৎপাদনে আরও হুমকির মুখে পড়েছে। হতাশ হয়ে পড়ছেন অনেক মৎস্যজীবিরাও।
বকুল মালাকার, অধন পালসহ কয়েকজন মৎস্যজীবি বলেন, অন্যান্য বছরে এসময়ে আমরা প্রতিদিন গড়ে হাজার খানেক টাকার মাছ ধরে বিক্রি করতাম। আমাদের জীবিকাও ভালোই চলেছে। বর্তমানে সময় যতো গড়াচ্ছে ততোই মাছের আবাসস্থল ভরাট হচ্ছে। নিজের খাবারের জন্যও নদী, বিলে মাছ পাওয়া দায় হয়ে পড়েছে। আমাদের পরিবার সংকুলান করাও কঠিন হয়ে উঠছে।
কমলগঞ্জের হাওর ও নদী রক্ষা আঞ্চলিক কমিটির সদস্য সচিব ইউপি সদস্য তোয়াবুর রহমান বলেন, ফি বছর বর্ষা মওসুমে আমরা কেওলার হাওরসহ নদী, ছড়া ও জলাশয় থেকে ছোটবড় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আহরন করতাম। মৎস্যজীবিদের কাছ থেকেও তরতাজা মাছ কিনে নিতাম। তবে বর্তমান সময়ে মাছের উৎপাদন অনেকটা কমে গেছে।
কমলগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা শহিদুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে বৃষ্টিপাতের তারতম্য দেখা দিয়েছে। তাছাড়া চাবাগান ও কৃষিক্ষেতে অত্যধিক পরিমাণে রাসায়নিক সার, কীটনাশক প্রয়োগে মাছের প্রজনন বিনষ্ট হচ্ছে। নানা কারনে আবাসস্থল বিনষ্ট হওয়ায় দেশীয় মাছের সংকট সৃষ্টি হচ্ছে।