পেঁয়াজের পিকআপ ভ্যানে করে দেশ ছাড়েন সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান
মঈন উদ্দিন ও সাঈদ চৌধুরী টিপু:
পেঁয়াজ পরিবহনের একটি পিকআপ ভ্যান এগিয়ে চলেছে তামাবিলের দিকে। সে পিকআপের যাত্রী সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। কদিন আগেও যিনি দামি গাড়িতে করে নগর চষে বেড়িয়েছেন সেই তিনিই পিকআপ ভ্যানে নিজেকে আড়াল করে ছুটে চলছেন সীমান্তের দিকে। তার সঙ্গী যুবলীগ নেতা এম এ হান্নান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে শ্যুটার হয়ে উঠা রুহুল আলম শিপলু। আগেই ব্যবস্থা করে রাখা ছিলো, জনপ্রতি দুই লাখ টাকার চুক্তিতে তাদের সীমান্ত পার করিয়ে দেবেন চিনি-পেঁয়াজের চোরকারবারিরা সিলেটে যারা ‘বুঙ্গাড়ি’ হিসেবে পরিচিত। ১৪ আগস্ট বাংলাদেশের সীমানা পার হন তারা।
সূত্র নিশ্চিত করেছে, তাদের সীমানার ওপারে পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত তদারকির দায়িত্বে ছিলেন সিলেট বিএনপির প্রভাবশালী এক নেতা। সীমানা পেরিয়ে আর দেরি করেননি, ১৫ আগস্টই যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান এ তিনজন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণে পরিস্থিতির হঠাৎ পরিবর্তন না হলে এদিন তাদের নগরীতে বিশাল আয়োজনে জাতীয় শোক দিবস পালনের কথা ছিলো।
পরিস্থিতি যে আর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেই সরকার পতনের আগে সেটি যে সবাই বুঝতে পারেননি তা নয়। আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ কেউ ঠিকই আঁচ করেছিলেন সময় ফুরিয়ে আসছে। তাদেরই একজন রঞ্জিত সরকার। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে প্রথমবারের মতো সুনামগঞ্জ-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য হওয়া রঞ্জিত সরকার টের পাচ্ছিলেন এখনই সটকে পড়তে না পারলে সামনে মহাবিপদ। ৪ আগস্ট সিলেট নগরীর বন্দরবাজারে আওয়ামী লীগের কর্মসুচি চলাকালে খুব বেশি তাড়াহুড়া লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো তার মাঝে। ওই দিন কোনো এক সময় সুনামগঞ্জের তাহিরপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাড়ি জমান।
রঞ্জিত সরকারের দেশ ছাড়ার পরদিনই পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। ৩০ আগস্ট যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান তিনি। তার সঙ্গে একই ফ্লাইটে উড়াল দেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিধান কুমার সাহা। যদিও তিনি ভারত পাড়ি দিয়েছিলেনর রঞ্জিত সরকারের পরে।
সিলেটের রাজনীতিতে ‘কৌশলী’ হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধরী নাদেলও দেশ ছাড়েন সরকার পতনের আগের দিন অর্থাৎ ৪ আগস্ট। মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হওয়া নাদেল দেশ ছাড়ার রুট হিসেবে বেছে নেন ময়মনসিংহকে। দলের ময়মনসিংহ বিভাগের সাংগঠনিক দায়িত্ব থাকায় এখানে তার অনেকের সঙ্গে চেনাজানা হয়ে ওঠে। সেটাকেই কাজে লাগান তিনি। নিজের এলাকা হওয়ায় সিলেট হয়ে দেশ ছাড়তে গেলে বিপদে পড়ার ঝুঁকি বেশি। তিনি সে ঝুঁকি নেননি। শফিউল আলম নেেদলের এ কৌশল ভালোই কাজে দিয়েছে। প্রথম কিছুদিন মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ে কাটিয়ে এখন অবস্থান করছেন পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায়।
সিলেট হয়ে দেশ ছাড়াকে বিপজ্জনক মনে করেছিলেন সিলেট-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিবও। তিনিও নিরাপদে দেশ পার হওয়ার জন্য বেছে নেন অচেনা সীমান্ত। সরকার পতনের দুদিন পরই কুমিল্লার সীমান্ত দিয়ে ত্রিপুরা হয়ে লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছেন হাবিবুর রহমান হাবিব। ২৯ সেপ্টেম্বর তিনি যুক্তরাজ্যের উদ্দেশ্যে ভারত ছাড়েন। একই ফ্লাইটে তার সঙ্গী ছিলেন হবিগঞ্জ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবু জাহির।
যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমিয়েছেন সিলেট ২ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী। আগস্টের ১৮-১৯ তারিখের মধ্যে তামাবিল সীমান্ত হয়ে দেশ ছাড়েন। দুয়েকদিন পরই যুকরাজ্যের উদ্দেশে উড়াল দেন শফিকুর রহমান।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ ১৮ সেপ্টেম্বর তামাবিল হয়ে বাংলাদেশের সীমানা ত্যাগ করে ভারতে যান। সেখান থেকে পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে। মাসখানেক ভারতে অবস্থানের পর যুক্তরাজ্যে নিজের বাসায় ওঠেন তিনি।
দেশ ছাড়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি নেন মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মুশফিক জায়গীরদার। তিনি তিনি ১৮ আগস্ট শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্লেনে চেপে পাড়ি জামিয়েছেন ইংল্যান্ডে।
সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিলেট জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খান. মহানগর আওয়ামী লীগের পিযুষ কান্তি দে, সিলেট জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আফসর আজিজ, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আফতাব হোসেন খান এখন ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ে অবস্থান করছেন। তারা সকলেই সীমানা পেরিয়েছেন তামাবিল হয়ে।
৫ আগস্টের আগে মাঠ দাপানো সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজ, মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাঈম ইসলাম এখন কলকাতায় অবস্থান করছেন। আর মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি কিশওয়ার জাহাস সৌরভ সরকার পতনের আগের দিন ৪ আগস্ট সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে আমেরিকর উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন।
অপরদিকে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন ঢাকাতেই আছেন বলেই জানা গেছে। তবে কেথায় আছেন সে ব্যাপরে কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি।
সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদও নিজের এলাকাতেই অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। খোঁঁজ মিলছে না সিলেট-৪ আসনের সংসদ সদস্য ইমরান আহমদের। এলাকায় কানাঘুঁষা তিনি নাকি পাকিস্তানে চলে গেছেন।