নূরুল মোহাইমীন মিল্টন, কমলগঞ্জ:
দেশের চা বাগান সমুহে মারাত্মক হারে বাড়ছে বেকারত্ব। বেকারত্বের বোঝা নিয়ে চা বাগান সমুহে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিচ্ছে। বেকারদের মধ্যে এসে যুক্ত হচ্ছে শিক্ষিত যুবক-যুবতিরা। মা-বাবার স্বপ্নকে লালন করে বিএ, অনার্স, মাস্টার্স পাস করে হন্যে হয়ে খুঁজছে চাকুরি।

তবে চাকুরি না পেয়ে নানা যন্ত্রনার মধ্যে দিনাতিপাত করছে অনেকে। কেউ কেউ হতাশাগ্রহস্ত জীবন যাপন করছে। মধ্যবয়সি ও শত শত যুবক যুবতিরা কাজের সন্ধানে বস্তি ও নার্সারী সমুহে কাজের সন্ধানে ছুটে বেড়াচ্ছে।
চা শ্রমিকরা জানান, পরিবারের সাত, আট সদস্যের মধ্যে একজনের দৈনিক মাত্র ১৮৭ টাকা মজুরিতে কোন মতেই সংসার চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এরমধ্যে চিকিৎসা, বাসস্থান, লেখাপড়া করানো ও পুষ্টিকর খাবার সাধ্যের বাইরে রয়েছে।
সারাদেশে ১৬৭টি চা বাগানের মধ্যে নারী, পুরুষ ও শিশু মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ চা শ্রমিক জনগোষ্টি রয়েছে। এদের মধ্যে চা বাগানে স্থায়ী এবং অস্থায়ী মিলিয়ে কর্মরত আছেন প্রায় ১ লাখ ২৩ হাজার জনগোষ্ঠি। এছাড়া প্রায় অর্ধলক্ষাধিক শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠি এবং প্রায় আড়াই লাখ বেকার নারী পুরুষ রয়েছে। শিক্ষিতদের যুবক যুবতিদের মধ্যে এসএসসি, এইচএসসি, বিএ, মাস্টার্স সম্পন্নও রয়েছে। শিক্ষিত যুবক-যুবতিরা চাকুরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে। তারপরও চাকুরি না পেয়ে হতাশ জীবন ধারণ করছে। যুব সামজের মধ্যে কেউ কেউ নেশাগ্রস্থও হয়ে পড়ছেন। চা বাগানের মধ্যবয়সি বেকার নারী ও পুরুষ এবং কিছু যুবক ও যুবতি বাগানে কাজ না পেয়ে বস্তি এলাকা, বিল্ডিং কন্ট্রাকশন, মাটি কাটা, লাকড়ি করা, কৃষিকাজ ও নার্সারী সমুহে কাজ করে সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করা শমশেরনগর চা বাগানের এক যুবক বলেন, ‘চাকুরির জন্য আবেদনের সাথে কাগজপত্র জমা দিতে দিতে অনেক টাকা খরচ করে ফেলছি। চাকুরি পাওয়া এতো কঠিন জানলে লেখাপড়াই করতাম না।’ একইভাবে দেওছড়া চা বাগানের বিএ পাস অমৃত রবিদাস, রঞ্জিত রবিদাস, কানিহাটি চা বাগানের বিএ-অনার্স সন্ধিপ বীন, মাস্টার্স উত্তীর্ণ সঙ্গীতা বীন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা দিয়েছি, চাকুরি হয়নি। লেখাপড়া শেষ করে যদি চাকুরিই না পাওয়া যায়, তাহলে লেখাপড়া করে কি লাভ? তারা আরো বলেন, বিভিন্ন চা বাগানে অসংখ্য ছেলেমেয়ে শিক্ষিত হয়ে শুধু বেকার জীবন যাপনই করছে না, হতাশাগ্রস্ত হয়েও পড়ছে।
শমশেরনগর কানিহাটি চা বাগানের প্রাক্তন ইউপি সদস্য ও চা শ্রমিক নেতা সীতারাম বীন বলেন, চা বাগানে বেকারত্বে বোঝা ভয়াবহ। কাজকর্ম না পেয়ে অনেকেই চরম অভাব অনটনে দিনযাপন করছে। শিক্ষিত বেকাররাও হতাশ হয়ে পড়ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরনে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ চা শিল্পে বাগানের পতিত জমিতে নতুন চা বাগান করা, কারিগরি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, নিরাপত্তা গ্রুপ তৈরি, শিক্ষার হার বৃদ্ধির জন্য চা শ্রমিক, মালিক ও সরকার পক্ষকে একযোগে কাজ করে বেকারত্ব মুক্ত না করলে ভবিষ্যতে সমস্যা আরো প্রকট হয়ে দেখা দেবে।
শমশেরনগর চা বাগানের যুবনেতা মোহন রবিদাস বলেন, আমাদের চা বাগানে বেকারত্বের বোঝা ভারী হচ্ছে। যুবকদের অনেকেই বিপথগামী হচ্ছে। কাজকর্ম না থাকায় বেকার মধ্যবয়সিরা নানা অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হয়ে দু:খ-কষ্টে জীবন যাপন করছেন। অভাবী সংসারের লাগাম টানতে কেউ কেউ বস্তি এলাকায় গিয়ে মাটি কাটা, লাকড়ি কাটা সহ কঠিন কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
চা শ্রমিক ইউনিয়নের প্রাক্তন উপদেষ্টা রাজভজন কৈরী জানান, চা বাগানে শ্রমিকদের ব্যাপক একটি অংশ বেকার রয়েছে। সারাদেশে চা বাগানের শিক্ষিত চা জনগোষ্ঠির সুনির্দিষ্ট জরিপ সম্পন্ন করা না হলেও প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠি রয়েছে। এছাড়া এসএসসি পর্যায়ে উত্তীর্ণ অনুত্তীর্ণদের মধ্যে রয়েছে শোচনীয় অবস্থা। তিনি আরও বলেন, এদের কর্মসংস্থানের জন্য মালিক পক্ষের সাথে আলোচনা হয়েছে, শ্রমিকের ক্ষেত্রে শ্রমিক নিয়োগ, ৭টি ভ্যালিতে কারিগরি বিদ্যালয় স্থাপন ও সরকারি চাকুরীতে উচ্চ শিক্ষিতদের ক্ষেত্রে কৌটা সুবিধার দাবি জানানো হয়েছে।


