ধর্মপাশা – মধ্যনগর প্রতিনিধি:
বর্ষা এলেই পানিতে ডুবে যায় সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলার বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চল। মধ্যনগর বাজার পার হলেই চোখে পড়ে সেই জলরাশি, যা স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রা, যেমন বদলে দেয়, তেমনি বাধা হয়ে দাঁড়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াতে। ফলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য স্কুলে পৌঁছানো হয়ে ওঠে একরকম জীবনের ঝুঁকি নেয়ার শামিল। বর্ষার ছয় মাসে অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি অর্ধেকে নেমে আসে।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে মধ্যনগর উপজেলা দেশের অন্যতম দুর্গম হাওর এলাকা। বর্ষায় এখানে সড়ক যোগাযোগ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। স্থানীয়দের ভাষায়, ‘ছয় মাস নাও, ছয় মাস পাও’। অর্থাৎ বর্ষায় জলপথই একমাত্র ভরসা। শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়কেই ট্রলার বা নৌকায় করে প্রতিদিন হাওর পেরিয়ে বিদ্যালয়ে যেতে হয়। বৈরী আবহাওয়া, ঝড়-বৃষ্টি ও দুর্যোগপূর্ণ দিনে এই যাত্রা হয়ে ওঠে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
এলাকার বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই শিক্ষকদের নেই বিদ্যালয়ের নিজস্ব থাকার কোনো ব্যবস্থা। নৌ সমস্যা দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে নারী শিক্ষকরা নৌযানও। ফলে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় যাতায়াতে নিরাপত্তার অভাবে স্কুলে পৌঁছাতে হিমশিম খান।
অন্যদিকে, প্রাথমিকের শি শিক্ষার্থীদের অনেকেই সাঁতার জানে না। ফলে বর্ষায় সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে ভয় পান অভিভাবকরা। প্রতি বছর হাওরে নৌকাডুবিতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটায় এই ভয় আরো বাড়িয়ে তোলে। এ কারণে অনেকেই সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে নিরুৎসাহিত বোধ করেন।
সরেজমিন বংশীকুন্ডা দক্ষিণ ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বর্ষা মৌসুমে বিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযোগ সড়ক তলিয়ে যায় পানিতে। শিক্ষার্থীদের একমাত্র ভরসা নৌকা। কিন্তু সবার পক্ষে নৌকা সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। আবার যারা নৌকায় আসেন, তাদের অনেকেই অনিয়মিত উপস্থিত হন বৈরী আবহাওয়া, বন্যা ও ঝড়-বৃষ্টির কারণে।
বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, প্রতি বছর বর্ষায় আমরা বুঝি, শিক্ষাটা এখানে একটি মৌসুমি বিষয় হয়ে প্রাথমিক শিক্ষায় সমতা ও ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হাওরের বাস্তবতা বুঝে পরিকল্পনা নেয়া জরুরি স্থানীয়ভাবে উপযোগী নৌযান এবং শিক্ষকদের জন্য আবাসন প্রয়োজন। বর্ষায় শিশুরা স্কুলে আসতে পারে না, শিখতেও পারে না।
মধ্যনগর সদর ইউপি সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা আব্দুল কাইয়ুম মজনু বলেন, বর্ষাকালে হাওরের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিতে সরকারি হস্তক্ষেপ এখন জরুরি। আগে হাওরে ‘বাংলো’ প্রথা চালু ছিল, যেখানে শিক্ষকরা থাকতেন ও স্থানীয় শিক্ষার্থীদের পড়াতেন। এখন সেই প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় শিক্ষকরা আবাসন সমস্যায় পড়েছেন, বিশেষ করে নারী শিক্ষকরা।
কাকরহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাসিমূল গনী তালুকদার বলেন, সরকারি বা স্থানীয় উদ্যোগে বর্ষায় উপযোগী নৌযান বরাদ্দ করা হলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়ের জন্য যাতায়াত সহজ ও নিরাপদ হবে। এতে বিদ্যালয়ে উপস্থিতিও বাড়বে।
স্থানীয় সচেতন মহলের মতে, বর্ষায় হাওরাঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। প্রাথমিক শিক্ষায় সমতা ও ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হলে হাওরের বাস্তবতা বুঝে পরিকল্পনা নেয়া জরুরি। । শিক্ষার্থীদের শি নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে স্থানীয়ভাবে উপযোগী নৌযান এবং শিক্ষকদের জন্য আবাসন- এ দুই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করলেই কেবল এই জনপদের শিক্ষার গতি ফেরানো সম্ভব।
মধ্যনগর উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, বর্ষাকালে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কমে যাওয়া একটি বাস্তবতা। আমরা এই সমস্যা সমাধানে প্রতিটি বিদ্যালয়ের জন্য সরকারি নৌযান বরাদ্দের একটি প্রস্তাব প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে পাঠিয়েছি।


