মাঈন উদ্দিন, শাবি:
উদ্ভাবন, গবেষণা, একাডেমিক সাফল্য ও এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞানও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি)। চলতিবছরের বিশ্ববিদ্যালয়টি ৩৫ বছরে পদার্পণ করেছে।

একাডেমিক অগ্রযাত্রা
দেশের প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উচ্চ শিক্ষায়তন শাবিপ্রবি। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শ্রেষ্ঠ এই বিদ্যাপীঠ স্বগৌরবে দ্যুতি ছড়াচ্ছে। ১৯৮৬ প্রতিষ্ঠিত হলেও শাবিপ্রবিতে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে। শুরুতে তিনটি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে সাতটি অনুষদে অধীনে ২৮টি বিভাগ রয়েছে। প্রথমদিকে অর্থনীতি, রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল এই বিদ্যাপীঠের। পরবর্তীতে বিজ্ঞানের আধুনিক বিষয়াদি ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ খোলা হয়। বর্তমানে আরও ১৩টি বিভাগ খোলার জন্য আলোচনা চলছে।

উদ্ভাবনে যেন সেরাদের সেরা
নিত্যনতুন উদ্ভাবনী প্রযুক্তি তৈরি করে আলোড়ন সৃষ্টি করছে শাবিপ্রবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। উদ্ভাবনে তাদের অর্জনের ঝুলিতে যেন কমতি নেই। ২০০৯ সালে শাবিপ্রবিতেই প্রথমবারের মত দেশে এসএমএস-ভিত্তিক ভর্তি ব্যবস্থা চালু হয়। এজন্য আন্তর্জাতিক ও সরকাররের স্বীকৃতি মেলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে পুরো দেশে এসএমএসভিত্তিক ভর্তিপদ্ধতি বাস্তবায়ন করে সরকার।

শিক্ষার্থীদের তৈরি প্রথম বাংলা সার্চ ইঞ্জিন ‘পিপীলিকা’ রয়েছে তালিকায়। বানান সংশোধন, অভিধান, খবরসহ প্রভৃতি কাজ করা যেত এর মাধ্যমে। এতেই থেমে না গিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে শিক্ষার্থী তৈরি করলেন ‘একুশে’ কিবোর্ড। শব্দানুমান এ যেন ছিল অনন্য প্রতিকৃত।
উদ্ভাবনের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকেরাও ছিলেন সহযোগী। মাত্র ১০-২০ মিনিটে ক্যান্সার শনাক্ত করা এমন প্রযুক্তি তৈরি করেন একদল শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের তৈরি আরও কয়েকটি সাড়া জাগানো উদ্ভাবনের মধ্যে রয়েছে- স্বয়ংক্রিয় গাড়ি ‘অটোমামা’, কথা বলা রোবট ‘রিবো’ ও হাঁটতে পারে রোবট ‘লি’, দৃষ্টপ্রতিবন্ধীদের জন্য স্বল্পমূল্যের ই-ব্রেইল প্রযুক্তি প্রভৃতি।
এছাড়া আইডিয়া উদ্ভাবনের সুনাম কুড়াচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। অনন্য সব আইডিয়া দিয়ে পুরস্কার পাচ্ছেন এ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা। কারও কারও আইডিয়া এখন বাজারেও জায়গা করে নিয়েছে। এর মধ্যে প্রীতিলতা অন্যতম।
গবেষণা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
উদ্ভাবনের ও গবেষণায় পাশাপাশি বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায়ও শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক সফলতা রয়েছে। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা আয়োজিত মহাকাশ অ্যাপস চ্যালেঞ্জ-এ শাবিপ্রবির ‘টিম অলিক’ বিশ্বসেরা চারটি দলের একটি হিসেবে নির্বাচিত হয়, যা বাংলাদেশের জন্য এক গৌরবজনক অর্জন এনে দেয়।
এছাড়া ২০২০ সালে আয়োজিত জাতীয় প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতাতে শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের দল ‘ডিফাইন কোডার্স’ চ্যাম্পিয়ন ও ২০২৩ সালে যুব গণিত চ্যালেঞ্জ প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীরা স্বর্ণপদক লাভ করে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইসিপিসি এশিয়া-পশ্চিম আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় শাবিপ্রবির ‘ফ্যানাটিকস’ দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছে।
পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা নিয়মিত বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড-এ অংশগ্রহণ করে থাকে। দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এসব অলিম্পিয়াডে তাঁরা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পুরস্কার অর্জন করেছে।
এছাড়া শাবিপ্রবির শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বহু দেশে শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে যুক্ত রয়েছেন। এটি প্রমাণ করে যে, শাবিপ্রবি আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছেছে।
বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি
ইলেকট্রোকেমিস্ট্রি এন্ড ক্যাটালাইসিস রিসার্চ ল্যাবরেটরি (ইসিআরএল) থেকে ১০ বছরে শুধু শিক্ষার্থীদেরই ১২৫টিরও বেশি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। এরকম প্রতিটি বিভাগেই শিক্ষকদের সহযোগিতায় শিক্ষার্থীরা গবেষণায় যুক্ত হয়ে সাফল্য অর্জন করছেন। শিক্ষকেরাও এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের গবেষণায় সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছেন।
এর প্রেক্ষিতে গত বছরে ২০২৪ সালে সিমাগো র্যাঙ্কিংয়ে গবেষণায় ১০ম এবং সামাজিক প্রভাবে ৪র্থ স্থানে উঠে আসে শাবিপ্রবি। এছাড়া কিউএস র্যাংকিংয়ে দেশে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে।
আন্তাজার্তিক বিজ্ঞানভিত্তিক পরিমাপক সায়েন্টিফিক ইনডেক্স অনুসারে শিক্ষকদের আন্তর্জাতিক অব¯’ান আরও উন্নত হয়েছে। তাদের এই সাফল্য গবেষণার জোরালো ভিত্তি তৈরি করছে।
এছাড়া প্রতিবছরই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তিন শতাধিক গবেষণাপত্র বিশ্বের বিখ্যাত জার্নালে প্রকাশিত হয়ে আসছে।

সবুজে ঘেরা টিলাবেষ্টিত ক্যাম্পাস
শুধু উদ্ভাবন ও গবেষণায় যুক্তই থাকে না এখানকার শিক্ষার্থীরা। সবুজের ঘেরা এই ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা আড্ডায় মেতে উঠেন প্রতিমুহূর্তে । ৩২০ একরের এই ক্যাম্পাসে প্রায় ১২০ এলাকাজুড়ে রয়েছে ছোট টিলা। যা ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যকে অনেকগুন বাড়িয়ে তুলেছে। চারপাশে বনজ গাছ, লতা-পাতায় ক্যাম্পাস আচ্ছাদিত রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের সাথে অবস্থিত । সেখান থেকে গোলচত্ত্বর পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তাকে বলা হয় ‘কিলো রোড’। এই রাস্তাটির দুই পাশে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন লেক। বর্ষার শুরুতে রাস্তার পাশে থাকা জারুল গাছে বেগুনি ফুল ফুটে। এই দৃশ্য এক অনন্য প্রাকৃতিক আবহ তৈরি করে। শত সোপানবিশিষ্ট শহীদ মিনার শাবিপ্রবির আরেকটি আকর্ষণ। এটি দেশের সবচেয়ে উঁচু স্থানে নির্মিত হওয়া একমাত্র শহীদ মিনার। এই অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু এটি। নতুন করে যুক্ত হয়েছে শহীদ রুদ্র সেন লেক। যা ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য দ্বীগুন করেছে। পর্যটকদের জন্য এই ক্যাম্পাস অন্যতম পছন্দের জায়গা।

এসব জায়গায় শিক্ষার্থীরা চড়ুইবাতি, সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা কিংবা বার্বিকিউ পার্টি করে থাকেন। সবুজ দিয়ে বেষ্টিত থাকায় তাপমাত্রাও তুলনামূরক কম থাকে। এতে শিক্ষার্থীদের মানসিক গঠন ও পড়াশোনায় মনোযোগী হতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

উপাচার্যের বক্তব্য
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ. এম. সরওয়ার উদ্দিন চৌধুরী দৈনিক আমার দেশকে বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে একসাথে প্রায় বিশটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, যার কাজ ইতোমধ্যে দৃশ্যমান এবং দুই বছরের মধ্যে সম্পন্ন হবে। এতে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা, গবেষণা, ল্যাব ও শ্রেণিকক্ষের কোনো সংকট থাকবে না। বিশ্ববিদ্যালয়কে সেন্টার অব এক্সেলেন্স হিসেবে গড়ে তুলতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং নতুন করে ১৩টি বিভাগ চালুর অনুমোদনের আবেদন করা হয়েছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখতে গবেষণায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে; এ বছর পিএইচডি শিক্ষার্থীদের বৃত্তি ছয় হাজার থেকে বাড়িয়ে ত্রিশ হাজার করা হয়েছে এবং গবেষণার জন্য বিভিন্ন তহবিল গঠন করা হয়েছে। পূর্বের উপাচার্য কর্তৃক আটকে রাখা প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থীর বৃত্তি পুনরায় প্রদান করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রনিক সিস্টেম মেরামত, উন্নত ইন্টারনেট সুবিধার জন্য অপটিক্যাল ফাইবার স্থাপনসহ সর্বোপরি শাবিপ্রবিকে একটি আধুনিক ইলেকট্রনিক হাব হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।


